একজন শিল্পীকে বুঝতে চাইলে তার মানসগঠনটাই আগে বুঝে নিতে হয়। সৃজনক্রিয়ার আড়ালে যে অদৃশ্য মানসটি থাকে সেটিই মূলত অনুসন্ধান করতে হয়। যে অন্তর্গত আবেদন শিল্পীসত্তাকে প্রণোদিত করে, তার নিরিখেই তাকে বিচার করতে হয়। এ কারণেই কথাশিল্পী হাজেরা নজরুলকে (জন্ম: ২০ নভেম্বর, ১৯৪২) নিয়ে আলোচনার শুরুতে আমরা তার মানসগঠনটি অনুধাবন করার চেষ্টা করি। তিনি একজন প্রবীন কথাশিল্পী। কাজ করেছেন কথা সাহিত্যের মাধ্যমে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, শিশুসাহিত্য; এমনকি কবিতাও লিখেছেন তিনি। শুধু লিখেছেন বললে বলাটা একেবারেই অসম্পূর্ণ হবে, সঙ্গে এ কথাও যোগ করতে হবেÑ লিখে তিনি এদেশের প্রধান প্রধান কবি, সাহিত্যিক, সমালোচকদের প্রশংসা যেমন কুড়িয়েছেন তেমনি তার পাঠকদের কাছেও হয়েছেন নন্দিত। মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনযুদ্ধ তাকে লেখার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে গেলেও, এই দুই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তিনি আবারও ফিরেছেন লেখার টেবিলে। কেন এই লেখা? কেন এত লেখা? এসব প্রশ্নের জবাব পেয়েছি আমরা তার জবানেÑ
‘লেখা যখন শুরু করি তখন প্রকাশের একটা বেগময়তা ছিল। একটা আনন্দময় তাড়ানা ছিল। পরবর্তীতে লেখাকে কমিটমেন্ট মনে করেছি। সংহত হয়েছি; পরিমিতি আনার চেষ্টা করেছি। একটি লেখা হচ্ছে একটি শিল্পকর্ম যা মানুষকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে’। (সাক্ষাৎকার। মেঘনাদ খান ও রোকেয়া ইসলাম। সাপ্তাহিক মেঘনা)
‘একটি লেখা হচ্ছে একটি শিল্পকর্ম যা মানুষকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে’Ñ লেখিকার এ উপলব্ধিই আমাদের জানিয়ে দেয়, লেখা তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দিকনির্দেশক শিল্পকর্ম সৃজন করার মানস লেখিকার শিল্পবোধ সম্পর্কে আমাদের জানান দেয় ; আমরা জানতে পারি তিনি নিজেকে কোন স্তরে উত্তীর্ণ করেছেন। হাজেরা নজরুলের এই প্রত্যয়ই শেষাবধি তার লেখক সত্তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
শুরুটা অধিকাংশ লেখকের মতে হলেও ‘আনন্দময় তাড়না’ তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষার পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছে। তাঁর রচনা ও চিন্তার সাথে পরিচিত হয়ে টের পাই আজও তিনি প্রতিশ্রুতি। কী সেই প্রতিশ্রুতি, যার জন্য তিনি বলেনÑ
‘প্রতিদিন আমার মনে একটা আশা জন্ম নেয়Ñআমি নিজেকে নতুন আশায় উদ্দীপ্ত করে তুলি, পাই চলার পথের নির্দেশনা।
[সাক্ষাৎকার। গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস]
নিজের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে হাজেরা নজরুল বলেনÑ ‘এটি কারো নির্দেশিত পথে নয়, স্বনির্দেশিত চেতনা থেকেই উৎসারিত।’ [ঐ] তার এই প্রতিশ্রুতি হচ্ছে সমাজ, স্বদেশ কিংবা মানুষের প্রতিদায়িত্বরোধ সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন বলেই প্রতিশ্রুত। এই প্রতিশ্রুতির ফলেই তাঁর সাহিত্যকর্ম লাভ করেছে নিজস্ব মাত্রা। আর এ কারণেই তিনি পাঠকের ওপর তার লেখার প্রভাবকে বিস্তার করতে পেরেছেন।
দুই
হাজেরা নজরুলের প্রথম লেখা প্রকাশ পায় ১৯৫৩ সালে, দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিলে। এটি ছিল একটি গল্প। গল্পটির নাম ‘ডিটেকটিভ’। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার প্রথম বইটি ছিল ছোটগল্পের। বইটির নাম ‘জোনাকির আলো’। জানা যায়, টিভিতে বইটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন মুনীর চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘হাজেরা অতি মিষ্টি প্রেমের গল্প লেখেন’। [হাজেরা নজরুল: অসাধারণ এক প্রজ্ঞার নাম। সুলতানা রাজিয়া]
তাঁর সম্পর্কে কবি আবদুল কাদিরও বলেছিলেন, ‘এ মেয়ের লেখায় মুন্সিয়ানা আছে, কালে বড় লেখক হবে।’ [সাক্ষাৎকার। গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পস]
সৈয়দ আলী আহসান হাজেরা নজরুলকে একজন ‘শক্তিশালী নাট্যকার’ বলে অভিহিত করেন। টিভিতে প্রচারিত দু’টি নাটকের সমালোচনা করতে গিয়ে এ অভিমত দেন তিনি। [হাজেরা নজরুল: অসাধারণ এক প্রজ্ঞার নাম। সুলতানা রাজিয়া]
দীর্ঘ পাঁচ যুগেরও অধিক কাল ধরে লিখছেন হাজেরা নজরুল। কিন্তু তার গ্রন্থসংখ্যা দেড় ডজনের বেশি নয়। তাঁর গল্পগ্রন্থ- (০১) জোনাকির আলো [১৯৬৮, ২০১৬], (০২) ফসিলে সূর্যগ্রহণ [১৯৮০, ১৯৭০, ২০০০], (০৩) সুবর্ণ সখী [১৯৮০], (০৪) ঘাসের পাখনায় আমার পালক [১৯৯০], (০৫) উত্তরণ [২০০১], (০৬) জলভরা মেঘ [২০১৪]। এছাড়াও ‘নির্বাচিত গল্প’ প্রকাশ পেয়েছে ২০১০ সালে। তাঁর উপন্যাস (০১) অমিত্রাক্ষর ছন্দ (০২) উপক্রমনিকা (০৩) বরফের ফুল (০৪) নির্বাসিত নির্ঝর (০৫) শরবিদ্ধ শিশির (০৬) চেনা সায়রে অচেনা ঢেউ। তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘ইচ্ছের ফুলগুলি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। শিশুদের জন্য লেখা একমাত্র গ্রন্থ ‘ভোম্বল মামা’। তাঁর বেশ কটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জাকারিয়া সিরাজী। অনূদিত গল্পগুলি নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘ঙহষু ঙহব খরভব ঃড় ষরাব’ [১৯৯০, ২০১২]। টেলিভিশনে হাজেরা নজরুলের বহুসংখ্যক নাটক প্রচারিত হয়েছে। এসব নাটক গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না হওয়ায় পাঠকের কাছে সেগুলো অনুপস্থিত। তবে প্রচারিত নাটকগুলোর বেশ ক’টির নাম উদ্ধার করতে পেরেছি আমরা। এগুলোর মধ্যে আছে (০১) শাড়ি বাড়ি গয়না (আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত, সৈয়দ আহসান আলী অভিনীত) (০২) সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে [মরহুম রাজু আহমেদ অভিনীত] (০৩) চাতক [আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত] (০৪) ত্রিরতœ (০৫) জীবন এক কাহিনী [আসাদুজ্জামান নূর অভিনীত, আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত]।
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি কুড়িটির মতো নাটক লিখেছেন, সেগুলো সবই রেডিও টিভিতে প্রচারিত। তবে এসব নাটকের রেকর্ড কিংবা স্ত্রিপ্ট লেখকের নিকট সংরক্ষিত নেই। ফলে নুতন প্রজন্মের সামনে তার গল্প, উপন্যাস উপস্থিত থাকলেও নেই নাটকগুলো।
দীর্ঘ পাঁচ যুগের অধিকাল ধরে হাজেরা নাজরুল শুধুই লেখালেখি করেননি, ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন প্রত্যক্ষভাবে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী এ যুদ্ধে শহীদ হয়ে গেছেন। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ শেষে তাতে শুরু করতে হয়েছে এক নতুন যুদ্ধ। সে যুদ্ধের নাম তিনিই দিয়েছেন জীবনযুদ্ধ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার চারজন শিশুসন্তান নিয়ে জীবনের মাঠে তাকে লড়ে যেতে হয়েছে। এ লড়াইও তিনি শেষ করেছেন। তবে একই দায়িত্ববোধ একই প্রতিশ্রুতি থেকে বিভিন্নমুখী লড়াই তার জীবনকে তিনটি খন্ডে দাঁড় করিয়েছেÑ মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধ ও সাহিত্যকর্ম।
তিন
হাজেরা নজরুল কথাসাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করলেও খ্যাতি লাভ করেছেন ছোটগল্পে। তার এসব ছোটগল্পের ওপর আলোকপাত করেছেন অনেকেই।
‘গল্পগুলোর সহজ গঠনযোগ্যতার চেয়েও বড় আকর্ষণ আমাদের চারপাশের বাস্তবতার কিছু উন্মোচন কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের অস্তিত্ব আর অনুভূতির জগতে নতুন আলোকসম্পাত। নতুন এ অর্থে যে, প্রত্যেক মানুষের দেখারই একটা স্বাতন্ত্র্য আছে, যদি না তা নেহাত প্রতিধ্বনি হয়। আর এ কথা মানতেই হবে যে, হাজেরা নজরুল তার গল্প নিজের পরিপাশর্^ তথা অভিজ্ঞতার জগৎ থেকেই চয়ন করে থাকেন। এটুকু নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার ছাপ প্রতিটি গল্পেই বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।’ [সালেহ চৌধুরী, দৈনিক বাংলা/নির্বাচিত গল্প। হাজেরা নজরুল]
‘সুবর্ণ সখী’ সাহিত্যের এক মূল্যবান অবদান। গল্পটি পারিবারিক ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার সংমিশ্রণ। তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়বস্তু বর্ণনার ছটায় ও ভাষার লালিত্যে হয়ে উঠেছে মোহনীয়।’ [দৈনিক আজাদ/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
তাঁর অনেক গল্প দেশীয় অবহে লেখা। কোনও বিদেশি গন্ধ নেই। নেই ধার করা শব্দের চাতুর্থ। আজকের এই মূল্যবোধহীন পরিস্থিতিতে গল্পগুলো পাঠককে সজাগ করতে পারে।, [দৈনিক মানবজমিন / নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
তাঁর গল্পের মধ্যে খুব সহজভাবেই এসেছে সমাজ, দেশ আর মানুষের আকুতির কথা। লেখিকার ভাষাজ্ঞান ও ঝরঝরে বর্ণনা, দক্ষ গল্প লেখিকা হিসেবে তাঁর নিজস্ব স্টাইল, চরিত্রানুযায়ী বাণীবিন্যাস ফুটে ওঠে। [পাক্ষিক অগ্রপথিক/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
‘দৃষ্টি’ গল্পের দোলা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট একটি অসাধারণ চরিত্র।… গল্পের প্রাণশক্তি এতটা প্রবল হয়ে ওঠে যে, গল্পের মাধ্যমে পাঠকের মনোযোগ নতুন আলোয় প্রবেশ করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। [এখনই সময়/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
‘আজন্ম গোলাম’ গল্পে যুদ্ধোত্তর এক সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে। আদর্শহীনতা, অর্থলিপ্সা, মিথ্যাচার, বঞ্চনা ও ছলনা সে সমাজের ও সময়ের চরিত্র।… লেখিকা পূর্বের তুলনায় অনেক সমাজ সচেতন, হয়েছেন বর্তমান জীবনের অবক্ষয়ের রূপ নির্মাতা [সচিত্র বাংলাদেশ/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
‘হাজেরা নজরুল সমাজ সচেতন লেখিকা। বর্তমান সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, মানুষের বৈরী আচরণ তাকে বিক্ষুব্ধ করে, যন্ত্রণাক্ত করে। তার প্রতিফলন ঘটেছে আকাক্সক্ষার স্বর্গে, ভিসিআর, ঝলকানো নিসর্গ, সুখ পাখিটির নীড় গল্পে। দেশ সমাজ মানুষ হাজেরা নজরুলের ভালোবাসা। এটাই তার অনেক প্রিয়। তাদের দুঃখ ব্যথা, নিপীড়ন, বঞ্চনা, হতাশা, দারিদ্র্য তাকে ক্ষুব্ধ করে, তাড়িত করে, ভাবিত করে। আহরণ এ দুঃখ নিরসনের চিন্তা তাকে ক্ষত বিক্ষত করে। [সচিত্র বাংলাদেশ/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]।
‘অস্ত্র’ গল্পটি সত্যিই একটি মজবুত প্লট এবং সাহসী চেতনা নিয়ে লেখা গল্প। হাজেরা নজরুলের ভাষা সাবলীল, বর্ণনা প্রাণবন্ত।’ [মুস্তফা নুরুল ইসলাম/দৈনিক ইত্তেফাক/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
‘লেখিকা তার ধীশক্তিতে, সৃজনশীলতার খাতে গল্পগুলিকে নিজ পায়ে দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। [আবুল কালাম মঞ্জুর মোরশেদ/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
বহুবর্ণময় জীবনের রঙিন ছবি আঁকতে গিয়ে যে দরদের সংমিশ্রণ তিনি করেছেন, যে সামগ্রিক সচেতনতা ফুটিয়ে তুলেছেন তা যে কারো পক্ষে জটিল এবং দুঃসাধ্য।… জীবনদৃষ্টির যে সুস্থ পরিচয় তার গল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের দেখাতে সক্ষম হন তা প্রশংসনীয় এবং অনন্যতায় উজ্জ্বল। [দৈনিক সংবাদ/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
তার প্রতিটি গল্প সাধারণ পাঠক-পাঠিকার অন্তর ছুঁতে সমর্থ এবং এটাই একজন লেখক বা লেখিকার জীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা। [তাসাদ্দুক হোসেন/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
‘হাজেরা নজরুলের বলিষ্ঠ ভাষা, সাবলীলতা পাঠককে তৃপ্তি দেয়’। [কবীর চৌধুরী/ যোগাযোগ বার্তা/১৯৯০]
‘ঘাসের পাখনায় আমার পালক’ ছোটগল্প সংকলনকে কথাশিল্পী নাজমুল আলম একটি সার্থক সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেন। [যোগাযোগ বার্তা/১৯৯০]
‘হাজেরা নজরুলের রয়েছে বলিষ্ঠ ও সাবলীল ভাষা, প্রকাশভঙ্গি এবং স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। [মনিরুজ্জামান/যোগাযোগ বার্তা/১৯৯০] তার গল্পের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতাত্তোর বাংরাদেশের সমাজ গঠন ও মানুষের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। হঠাৎ প্রাচুর্য এবং অনায়াসলব্ধ সুখ-সুবিধা বাঙালির অনেক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিয়েছে। নৈতিক অবক্ষয় জাতির মেরুদন্ডকে দুর্বল করে দিয়েছে। সন্ত্রাস, মাদক ইত্যাদি সম্পূর্ণ নতুন জিনিস যা গল্প উপন্যাসে ছিল তা চলে এসেছে নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনধারায়। সমাজে সে জন্য এত বিপর্যয়, এত বিভ্রান্তি। প্রাচুর্যের সাথে বাঙালি পরিবারে এসেছে অবক্ষয়। নারী আসক্তি, মাদকাসক্তি পারিবারিক শৃঙ্খলাকে করেছে ভঙ্গ। স্বামী অনায়াসে পরনারীতে আসক্ত হচ্ছেন, স্ত্রী পর-পুরুষের আনন্দের সাথী হচ্ছে অর্থের বিনিময়, সন্তানদের মধ্য জন্ম নিচ্ছে অসহায়ত্ব, নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রতিশোধ প্রতিক্রিয়া। ছোটগল্পে ছোটকথা বলার মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনকে যেভাবে প্রতিফলিত করা যায় অন্য কোন মাধ্যমে তা নম্ভব নয়।
পিতা-মাতার ¯েœহমমতা, স্বামীর ভালোবাসা, স্ত্রীর অনাবিল প্রেম, সন্তান একদিন শাশ^ত বাঙালি পরিবারের ¯েœহনীড় বন্ধন তৈরি করতো। স্বাধীনতার পর তা আরো নিবিড় ও প্রাণবন্ত না হয়ে বিপরীত ¯্রােতে বইতে লাগল। হাজেরা নজরুল তার প্রতিটি গল্পে এই ধারাটির চিত্র নিপুণভাবে এঁকেছেন। [সাপ্তাহিক পূর্বাণী/নির্বাচিত গল্প/হাজেরা নজরুল]
দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ ছয় দশক জুড়ে হাজেরা নজরুলের গল্প নিয়ে বিদগ্ধজন নানারকম মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু এসব মূল্যায়নের অধিকাংশই হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে তার বিভিন্ন গ্রন্থ নিয়ে, বিশেষ করে ছোটগল্প নিয়ে। সামগ্রিকভাবে তার সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন এখনো সেভাবে হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। বর্তমান আলোচনায় আমাদের পক্ষেও সম্ভব নয় তাঁর সৃষ্টিকর্মের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করা। সে কারণে তার ছোটগল্পই আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করে। বিদগ্ধজনের নানা অভিমতের মাধ্যমে আমরা জেনে নিতে পারি তাঁর ছোটগল্পের ভুবন সম্পর্কে।
হাজেরা নজরুলের গল্প পড়ে আমরা তাকে একজন সৎ, সাহসী, অকপট, আবেগময়, নিরাবরণ শিল্পী হিসেবে দেখতে পাই। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয় তাঁর অধিকাংশ গল্পের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিয়ষবস্তু। নি¤œবিত্ত চরিত্রগুলো তার গল্পের আত্মীয় হয়ে উঠেছে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থের ‘চোর’ গল্প থেকে শুরু করে আরও অনেক গল্পেই আমরা এ ধরনের চরিত্রের সন্ধান পাই। তাঁর গল্পে সূক্ষ্ম কারুকাজ, ভাষার অলঙ্কার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বিদ্যমান না থাকলেও মাঝেমাঝেই উপমা ও রূপকাশ্রয়ী বাক্যের চমক সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার গল্পে নাটকীয়তা আছে। বলা যায়, গল্পগুলো তার নাট্যময়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। তিনি তার কোনো কোনো বাক্যকে ছন্দময় করতে গিয়ে কাব্যময়তার গতিকে বাধাগ্রস্ত করেছেন। তবে এটাও তার ভাষার একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। তার গল্পে অনেক করুণ ও নির্মম বাস্তববতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। জুবাইটা গুলশান আরার মতে, ‘… হাজেরা নজরুল নিরন্তর জীবনের অন্বেষণ প্রয়াসী, তাঁর লেখায় জীবনঘনিষ্ঠ পারিবারিক চিত্র, হৃদয়স্পর্শী বেদনা দেখতে পাই। রোম্যান্সের পাশাপাশি রয়েছে নির্মম বাস্তবতার কঠিন কঠোর চিত্র। তার সঙ্গে মানবহৃদয়ের, নারী-পুরুষের রহস্যময় আলোছায়ার চিত্র দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। একাত্তরের মর্মান্তিক ঘটনাবলির সঙ্গে তার লেখার গভীর সংযোগ পাঠককে মুগ্ধ করে।’ [বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ স্মরণিকা ২০১০] শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হতাশা ও সঙ্কটের চিত্রও তার লেখায় উঠে এসেছে গভীর তাৎপর্যে।
ভাষার অলঙ্কার যেমন তাঁর গল্পকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি আবেগের লাগাম তাঁর কোথাও কোথাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবুও আমরা বলতে পারি হাজেরা নজরুলের অনেক লেখা পাঠককে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় উত্তরণে সাহায্য করে। লেখিকা নিজেও বলেছেন, ‘আমাদের একটি সুখময় প্রাপ্তিÑ আমার বহু লেখা বাস্তবে কারো কারো জীবনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বহুজনার জীবনে ব্যর্থতার মরুভূমিতে আশার ফুল ফুটিয়েছ। [সাক্ষাৎকার/ মেঘনাদ খান ও রোকেয়া ইসলাম/সাপ্তাহিক মেঘনা] আমরা আগেই জেনেছিÑ লেখক অশুভকে শুভর দিকে, অন্যায়কে ন্যায়ের দিকে, ব্যর্থতাকে সাফল্যের দিকে পরিবর্তিত করার মানসেই লেখালেখি করেন। এটাই তার লেখার প্রতিশ্রুতি।
চার
পরিবর্তনের আশা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন হাজেরা নজরুল। কিন্তু সেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পরে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেনÑ ‘কিন্তু লজ্জার কথা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর শুরু হলো ওয়াদার বরখেলাপি। সব অঙ্গীকার ভঙ্গ করে মানুষের সাথে প্রবঞ্চনা করল, সাধারণ মানুষ দরিদ্র হতে দরিদ্রতর হলো। দশগুণ থেকে শতগুণ হলো নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যমূল্য। টাকার মান কমে গেল। তৈরি হল পুঁজিবাদী এক নব্যসমাজ। দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে হলো নৈতিক অধঃপতন। চারিত্রিক ধস। মানবতার সমাধি’। [সাক্ষাৎকার/ মেঘনাদ খান ও রোকেয়া ইসলাম/সাপ্তাহিক মেঘনা]।
কেন এমন হলো? এ নিয়েও তিনি চিন্তা করেছেন। কিন্তু খুঁজে পাননি কোনো সমাধান, দিতে পারেননি কোনো ব্যাখ্যা। বরং তিনি উত্থাপন করেছেন এক মৌলিক প্রশ্নÑ ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে সকল শহীদের রক্তদান ব্যর্থ হলো কেন, সেই কাঙিক্ষত দেশ কেন তৈরি হলো নাÑ এটি বিপুল ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে’। [সাক্ষাৎকার/মেঘনাদ খান ও রোকেয়া ইসলাম/সাপ্তাহিক মেঘনা]
এই সাক্ষাৎকারে তিনি যে ব্যাখ্যা ও সমাধান খুঁজেছেন, সেটা এই সাক্ষাৎকার প্রদানের আরও বিশ বছর পরেও তিনি খুঁজছেন। অবশ্য আমরা এখনও জানতে পারিনি, তিনি এর সমাধান অথবা ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন কিনা। তবে আমাদের উপলব্ধির জগৎ বলে, মুক্তিযুদ্ধ একটি নিরন্তর যুদ্ধ, স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি নিরন্তর যুদ্ধ। এ কথাতো সবারই জানা যে, ‘স্বাধীনতা অর্জন করার চাইতে রক্ষা করা কঠিন।’ সুতরাং বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা লড়ে যান বিজয়ের তাৎপর্যকে সমুন্নত রাখতে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের আর সাক্ষাৎ মেলেনি, অর্থাৎ তারা আর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় থাকেননি। তারা ভৌগোলিক মুক্তিকেই মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন বলে মনে করেছেন। হাজেরা নজরুলের বেলাও তাই ঘটেছে। তিনিও মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে জীবনযুদ্ধই শুরু করেছেন। ফলে তার মধ্যে ভর করেছে অভিমানÑ ‘দেশ ও জাতির প্রতি আমার তীব্র অভিমান রয়েছে’। [সাক্ষাৎকার/ মেঘনাদ খান ও রোকেয়া ইসলাম/সাপ্তাহিক মেঘনা]
দেশ ও জাতির প্রতি কারো কোনো অভিমানই কাছে কাম্য নয়। দেশ ও জাতি আমাদেরই দানে ও অবদানে অস্তিত্ব পায়, সমৃদ্ধ হয়। দেশ ও জাতি কাউকেই কিছু দিতে পারে না। আমাদের মানবিক ক্রিয়াকর্মই দেশ ও জাতিকে কাঙ্কিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। তাই বলে আমরা হাজেরা নজরুলের সংগ্রামী জীবনকে অবমূল্যায়ন করতে পারি না। কেননা দেশ ও জাতির অস্তিত্ব যতখানি বিদ্যমান আছে তার পেছনে হাজেরা নজরুলের মতো মানুষদের অবদান আছে। যারা প্রতিশ্রুত ও দায়বদ্ধ তাদের অবদানই আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
অতএব, আমরা মনে করি, আমরা যদি নিরন্তর মুক্তিযোদ্ধা হতাম তাহলে এই সংকটে আমাদের আপতিত হতে হতো না। হারেজা নজরুলের ঐ বক্তব্যের দুই দশক পর আমাদের এই সংকট আরও প্রবলভাবে ঘনীভূত হয়েছে।
জীবনকে বিভিন্ন যুদ্ধে খন্ডিত করার কোনো কারণ আমরা দেখি না। জীবনযুদ্ধ কিংবা সাহিত্যসাধনা কোনটাই মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলাদা নয়। কোন জাতির মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা যতদিন সক্রিয় থাকে ততদিন সে জাতি অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারে। আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই নিহিত আছে বিচিত্র জীবন সংগ্রামের প্রকৃত তাৎপর্য। আমরা বর্তমানে যে লুটপাট, খুনোখুনি, অবিচার, দুর্নীতিসহ নানা অনাচারে ঘেরাও হয়ে আছি। এ থেকে মুক্তির জন্য নিরন্তর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কোনো বিকল্প আছে কি? হাজেরা নজরুল প্রবীণ হলেও প্রাচীন নন। আশা করি, তিনি এই যোগসূত্র মিলাতে পারবেন।
বিষয়সমূহঃTags: আহদ বাসির
পূর্বের সংবাদ
পরের সংবাদ